অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হলে কি করবেন ?
করোনা মহামারিতে যেমন একদিকে বেড়েছে অনলাইনে কেনাকাটা তেমনি বেড়েছে অনলাইনে প্রতারণা। প্রায়শই শোনা যায় ফেসবুক পেইজ, ফেসবুক ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ কিনবা বাংলাদেশের অনলাইন মার্কেট থেকে যে মানের প্রোডাক্ট পণ্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিল তার থেকে নিম্ন মানের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌছানো হয়েছে। আবার অনেক সময় এই রকমও শোনা গেছে যেইখানে বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপ বা পেজে পণ্যের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল, সেইগুলো আগাম অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
এই রকম একজন ভুক্তভোগী জনাব লাবিব। তিনি একবার এক ফেসবুক পেইজ থেকে মোবাইল অর্ডার দেন এবং সময় মতো পণ্যের ডেলিভারিও পান। কিন্তু তাকে নতুন মোবাইল ফোনের পরিবর্তে সেই মডেলেরই একটি রিফ্যাবরিশড হ্যান্ডসেট দেওয়া হয়। পরে তিনি সেই পেজের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টার অস্বীকৃতি জানান। শেষমেশ প্রতিকার না পেয়ে তিনি আইনের স্মরণাপন্ন হন এবং তার প্রতিকার পান।
কিন্তু মিস্টার লাবিবের মতো হয়ত অনেক নেটিজেন জানেন না অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারিত হলে তার প্রতিকার আছে। তাই আমদের আজকের আলোচনা ‘অনলাইনে প্রতারণার শিকার হলে কি করবেন’ ।
প্রতিকার ১
সব দিক পর্যালোচনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করাই সবচেয়ে কার্যকরী এবং দ্রুত পন্থা। অনলাইনে প্রতারিত হলে সংশ্লিষ্ট সাইট, গ্রুপের বা মার্কেট প্লেসের বিরুদ্ধে অভিযোগটি লিখিত আকারে ক্রয়ের রশিদসহ যাবতীয় তথ্য সংযুক্ত করে ভোক্তা অধিকার কার্যালয়ে ফ্যাক্স বা ই-মেইলে দিতে হবে। ঢাকা ছাড়া অন্য বিভাগের ক্ষেত্রে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বরাবর অভিযোগ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে পণ্য কেনার তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিকট অভিযোগ জানাতে হবে। অধিদপ্তরে অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা নিরূপণে দুই পক্ষ থেকে শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার আদেশ দিবেন। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানার টাকা আদায় শেষে ২৫ শতাংশ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা বা ক্রেতাকে প্রদান করা হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এর ৪৪ ধারা মতে ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের জন্য অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দেন এক্ষেত্রে তাকে অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এই আদেশের ফলে জরিমানা হিসেবে যে টাকা আদায় করা হবে তার ২৫ শতাংশ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে দেওয়া হবে।
প্রতিকার ২
ধরে নিন, আপনি কোন একটি ফেসবুক পেইজ থেকে একটি জ্যাকেট অর্ডার দিয়েছেন। ঐ পেজের প্রোডাক্ট ডিস্ক্রপসনে বলা হয়েছিল জ্যাকেটটি তিন লেয়ার বিশিষ্ট। কিন্তু প্রোডাক্টির ডেলিভারি পাওয়ার পর আপনি পুরাই হতাশ! কারণ, পেজের জ্যাকেটটির সাথে আপনাকে ডেলিভারি দেওয়া জ্যাকেটের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। আবার জ্যাকেটটিতে যেই রকম ৩টি স্তরের কথা বলা হয়েছিল, এইখানে কেবল একটি স্তর। এই ক্ষেত্রে আপনি স্রেফ প্রতারণার শিকার হলেন এবং বিক্রেতা আপনার সাথে প্রতারণা করলেন।
এইভাবে প্রতারণার শিকার হলে প্রতারিত ব্যক্তি, প্রতারণাকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে ৪২০ বা 420 ধারায় মামলা দায়ের করতে পারবে। কারণ প্রতারণা তা হতে পারে যেকোন ধরণের। পণ্য কেনা বা হাতে পাওয়ার পর সেটার রশিদ বা ক্যাশমেমো দিয়ে জেলা জজ আদালতে অথবা মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে মামলা করতে হবে। আদালত আপনার অভিযোগ যাচাই-বাচাই করবেন এবং অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিবেন যদি আদালতে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয় তাহলে আদালত অর্থদণ্ড বা কারাদণ্ড দিতে পারেন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে ।
প্রতিকার ৩ (ক্ষতিপূরণ বা বাধ্যতামূলক চুক্তি পালন)
মনে করুন, আপনার কোন দোকান আছে। সামনে ঈদ উপলক্ষে আপনি আপনার দোকানে কিছু পণ্য তুলতে চাইলেন এবং কোন অনলাইন মার্কেটপ্লেস থেকে বা ফেসবুক পেজ বা গ্রুপ থেকে সেগুলোর অর্ডার দিলেন এবং সময়মতো সেই পণ্যগুলো পেলেন। কিন্তু সমস্যা হলো সেই পণ্যগুলো খুবই নিম্নমানের বা আপনি যে পণ্যের অর্ডার দিয়েছিলেন, তার সাথে এইগুলোর মিল নেই। আর এর জন্য আপনি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেন।
এবং উপরের দুইটা প্রতিকারও আপনার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, আপনি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। একমাত্র ক্ষতিপূরণ বা বাধ্যতামূলক চুক্তি পালনই আপনার ক্ষতি পোষাতে পারে। তবে আপনি, আদালতে চুক্তি আইন অনুযায়ী মামলা করতে পারেন।
Contract Act বা চুক্তি আইন অনুযায়ী, চুক্তি হতে হয় দুজনের মধ্যে আর যখন কোন পন্য ক্রেতা কিনতে চায় এবং বিক্রেতা তা বিক্রি করতে চায় তখনি দুজনের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়। পণ্য নির্দিষ্ট সময় পরে বা কোন শর্ত সাপেক্ষে পণ্যের মালিকানা হস্তান্তর করার চুক্তিকে পণ্য বিক্রয় চুক্তি বলে। চুক্তি আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে চুক্তি ভঙ্গ করার পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। চুক্তিভঙ্গ করার জন্য ক্ষতি বা লোকসান ও চুক্তিবলে সৃষ্ট বাধ্যবাধকতা প্রতিপালনে ব্যর্থতার জন্য ক্ষতিপূরণ এবং ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। দায়িত্ব ভঙ্গ করলে দেওয়ানী অন্যায় সংঘটিত হয়। চুক্তি ভঙ্গ দেওয়ানী প্রকৃতির অন্যায়, ফৌজদারি অপরাধ নয়। এর প্রতিকার শাস্তি নয়, আর্থিক ক্ষতিপূরণ বা চুক্তি পালন। এইভাবে আপনি আপনার ক্ষতিপূরণ করতে পারেন।
কিন্তু আইন যতই থাক না কেন নিজের সচেতনাই পারে নিজেকে প্রতারিত হবার হাত থেকে রক্ষা করতে। চুক্তি আইনে ‘ক্যাভিয়াট এম্পটর’ নামে একটি মতবাদ আছে। অর্থাৎ ক্রেতা সাবধান নীতি। ক্রেতা যাতে প্রতারিত না হয়, সেদিকে তাকে নিজেই লক্ষ রাখতে হবে। অতএব নিজে সাবধান হন প্রতারণা থেকে রক্ষা পাবেন।
Responses